ফেসবুক, সহ ২৬টি সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করার কারণে নেপালে জনরোষ

ফেসবুক, সহ ২৬টি সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করার কারণে নেপালে জনরোষ

দুর্নীতির প্রতিবাদে নেপালে আন্দোলনের ডাক

সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আহ্বান জানানো এক দেশব্যাপী বিক্ষোভে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছে। দুর্নীতি ও সরকারের দায়মুক্তির প্রতিবাদে নেপালের যুবসমাজ এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। কাঠমান্ডু ও দেশের অন্যান্য শহরে শত শত মানুষ আহত হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চাশজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। হাসপাতালগুলির জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব দেখা দিয়েছে।

কান্তিপুরের দুই সাংবাদিক, দিপেন্দ্র ধুঙ্গানা ও শ্যাম শ্রেষ্ঠও আহত হয়েছেন, যখন তাঁরা সংসদ ভবনে ঢোকার চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের কভার করছিলেন। সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষ কাঠমান্ডুর মান্ডালা মোড়ে জড়ো হয়েছিল। শুরুতে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার উদ্দেশ্যে বিক্ষোভ হলেও পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি, সরকারের উদাসীনতা এবং শনিবার হঠাৎ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করার কারণে জনরোষ ফেটে পড়ে।

বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনের গেট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করলে পুলিশ জলকামান ও টিয়ারগ্যাস ব্যবহার করে। পরে জেলার প্রধান প্রশাসক গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এর পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাত ১০টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী সঞ্চিত মহারজন বলেন, তিনি কেবল দেখতে এসেছিলেন, কিন্তু টিয়ারগ্যাসে আহত হন। তাঁর কথায়, “আমি জেনারেশন জেডও নই, তবু তরুণদের এই অবস্থান দেখে শক্তি অনুভব করছি।”

টিকটকের মতো এখনও সক্রিয় কিছু প্ল্যাটফর্মে রক্তমাখা স্কুল ইউনিফর্মে ছাত্রছাত্রীদের ছবি ও আহত বিক্ষোভকারীদের বহন করার দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। সকাল ৯টা থেকেই ছাত্রছাত্রী ও তরুণেরা প্ল্যাকার্ড হাতে সমবেত হয়েছিলেন। জনপ্রিয় র‍্যাপার ওএমজি স্পার্ক এক পর্যায়ে মঞ্চে গান পরিবেশন করেন। এ আন্দোলনের পেছনে আন্তর্জাতিক #Nepobaby ট্রেন্ডও প্রভাব ফেলেছিল, যেখানে ক্ষমতাশালী নেতাদের সন্তান ও প্রভাবশালী ইনফ্লুয়েন্সারদের বিলাসবহুল জীবনযাপন প্রকাশ্যে আসায় ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়।

সরকারের যুক্তি ছিল কর রাজস্ব, সাইবার নিরাপত্তা ও কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণে সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু নেটিজেন, নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম এটিকে বাক্‌স্বাধীনতা দমন ও কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। ২২ বছরের শিক্ষার্থী সুমিতা খাড়কা বলেন, “যতক্ষণ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকে, তা কার্যকর হতে পারে। কিন্তু সহিংস হলে উল্টো পরিস্থিতি খারাপ হয়।”

অবস্থার অবনতির কারণে সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়, বিমানবন্দর সড়কে কারফিউ জারি করা হয়। সংগঠন ‘হামি নেপালি’ ঘোষণা দেয়, যারা সংসদে হামলা চালিয়েছে তারা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, বরং উগ্র গোষ্ঠী আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করেছে। বুটওয়াল, চিতওয়ান, পোখারা, মোড়েও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পোখারায়ও কারফিউ জারি করা হয়েছে।

এর মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক পদত্যাগ করেছেন। কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে সহিংসতায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ জনে দাঁড়ানোর পর প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগের দাবি উঠছে। শুধু বিরোধী দল নয়, শাসক দলের মধ্য থেকেও এই দাবি জোরালো হচ্ছে। মাওবাদীরা বলেছে, সরকারের বৈধতা শেষ হয়ে গেছে। তাদের মতে, তরুণদের ওপর গুলি চালিয়ে এক ডজনের বেশি প্রাণ নেওয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে।

মাওবাদী উপপ্রধান অগ্নি সাপকোটা বলেছেন, “যুবকদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটি গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই, ওলিকে সরে দাঁড়াতে হবে।” মাওবাদী নেতা বর্ষমান পুন বলেন, ওলির স্বৈরাচারী মানসিকতা দেশকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।

আরএসএস, আরএসপি, আরপিপি ও ঐক্যবদ্ধ সমাজবাদী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও ওলির পদত্যাগ দাবি করেছে। তারা বলছে, সরকার জনগণের রক্তে ভিজে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে, যা আর গ্রহণযোগ্য নয়। কংগ্রেস নেতা শেখর কোইরালা বলেন, “ছাত্রদের ওপর বই হাতে থাকার সময় গুলি চালানো হয়েছে, এটি এক বর্বরোচিত কাজ।”

ইউএমএল সাংসদ বিদ্যা ভট্টাচার্য ও কেন্দ্রীয় সদস্য উষা কিরণ তিমসিনাও বলেছেন, শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নয়, প্রধানমন্ত্রীকেও পদত্যাগ করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ সমাজবাদী দল ঘোষণা করেছে, প্রায় দুই ডজন নিরীহ নাগরিকের প্রাণহানি ঘটানো সরকারের আর নৈতিক অধিকার নেই।

বিভিন্ন দল একসঙ্গে বলছে, দমন-পীড়ন নয়, জনগণের দাবি শোনার মাধ্যমেই সমাধান আসতে পারে। কিন্তু তরুণদের রক্ত ঝরিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় থাকতে চায়, তার পতন অবশ্যম্ভাবী।

September 8, 2025