১৪ মার্চ ২০২৫
দোলযাত্রা: বাংলার হাজার বছরের রঙের উৎসব
যেখানে সমগ্র ভারতবর্ষে রঙের উৎসবকে হোলি নামে অভিহিত করা হয়, সেখানে বাংলায় এটি দোলযাত্রা নামে পরিচিত। এই উৎসবের শিকড় প্রোথিত রয়েছে প্রাচীন গৌড়ভূমির (গৌড় বঙ্গের) ইতিহাসে, যা পাল সাম্রাজ্যের (প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দ) সময়কাল থেকেই প্রচলিত। আজকের বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে বঙ্গাব্দ ১৪৩১ চলছে (শুক্রবার, ২৯ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ), যা প্রমাণ করে যে বাংলা পরিচয় অন্তত ১৪৩১ বছর পুরনো (৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ)। এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তিম পর্ব, যখন বৈদিক ধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল।
দোলযাত্রার ঐতিহাসিক পটভূমি ও বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব
বৈদিক দেবতা বিষ্ণু এই সময় আরও মানবিক ও প্রেমময় রূপে আবির্ভূত হন, যেখানে তিনি লীলা পুরুষোত্তম হিসেবে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন। পাল শাসকদের আমলে গৌড় বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম গভীর প্রভাব বিস্তার করে, বিশেষত রাজা গোপালের শাসনকালে। এই সময়ে বাঙালিরা নিজেদের সংস্কৃতি ও উৎসবগুলোর পুনর্নির্মাণ করেন, যার মধ্যে তিনটি প্রধান উৎসব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে—
- রঙের উৎসব (দোলযাত্রা) – শীতের বিদায়ের প্রতীক
- আলো ও দীপের উৎসব (দীপাবলি) – শীতের সূচনার প্রতীক
- দেবশক্তির আরাধনার উৎসব (শারদোৎসব) – শক্তির পূজার নিদর্শন
দোলযাত্রার বৈশিষ্ট্য: রঙ, গান ও চন্দ্রালোকে দোলনা
ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোল পূর্ণিমার দিনে এই উৎসব পালিত হয়। দিনের বেলায় রঙের খেলা, সন্ধ্যায় সংগীত ও দোলনাচ এবং রাতে চন্দ্রালোকে বৃক্ষের ডালে ঝুলন্ত দোলনায় দোল খাওয়া—এইসব মিলিয়েই বাংলার ঐতিহ্যবাহী দোলযাত্রা।
বিশেষভাবে নবদ্বীপে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকেই দোলযাত্রার ধর্মীয় তাৎপর্য বৃদ্ধি পায়, যেখানে মহাপ্রভু তার অনুসারীদের নিয়ে রঙের খেলায় মেতে উঠতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও দোলযাত্রাকে বসন্ত উৎসবের সঙ্গে একাত্ম করেন এবং এই উপলক্ষে অনেক কবিতা ও গান রচনা করেন।
দোল উৎসব ও প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থা
কামসূত্রের রচয়িতা বৎসায়ন বৈশালী ও বজ্ঝি গণরাজ্যে বসন্ত উৎসবের উল্লেখ করেছেন, যেখানে যুবক-যুবতীরা স্নাতক (গ্র্যাজুয়েশন) সম্পন্ন করার পর নিজেদের জীবনসঙ্গী খোঁজার জন্য এই উৎসবে অংশ নিতেন।
✔ যৌন শিক্ষার প্রচলন:
তৎকালীন সমাজে গণিকারা (পেশাদার শিল্পী ও নর্তকী) যুবকদের আকর্ষণের কলা শেখাতেন, যা ‘কুট্টিনী’দের (কৌশল শিক্ষক) মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এই সময় নারীদের ৬৪টি কলা শেখানো হতো, যার মধ্যে ছিল সংগীত, নৃত্য, রূপসজ্জা, ভাষাশৈলী ও আকর্ষণের কলা।
✔ অপভাষা কাব্য ও ব্যঙ্গ-সংস্কৃতি:
বারাণসীতে হোলির আগের দিন লঙ্কা গ্রামে হাজার বছরের পুরনো একটি রীতি ছিল, যেখানে অপভাষা ও গালিগালাজের প্রতিযোগিতা আয়োজিত হতো।
➡ এই ঐতিহ্য ১৯৯৮ সালেও পালিত হয়েছে, যেখানে বারাণসীর পুলিশ সুপার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
➡ বাগেশ শাস্ত্রী ছিলেন সভার সভাপতি এবং চকাচক বেনারসি ছিলেন প্রধান অতিথি।
➡ এই প্রতিযোগিতায় অবিরত ৫ মিনিট গালি ব্যবহার করতে হতো এবং পুনরাবৃত্তি করা যেত না—এটি ছিল সত্যিই কঠিন একটি কাজ!
বাংলায় দোলযাত্রার গুরুত্ব: শান্তিনিকেতন থেকে মায়াপুর পর্যন্ত
✔ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে দোল উৎসবকে বসন্তোৎসব রূপে উদযাপন করেন, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকরা একসঙ্গে রঙের খেলায় মেতে উঠতেন।
✔ মায়াপুরে ইস্কন (ISKCON) দোলযাত্রাকে বৈষ্ণবধর্মের এক মহোৎসবে রূপান্তরিত করেছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে কীর্তন, ভক্তিনৃত্য ও মহাপ্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে উৎসব পালন করেন।
✔ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ভাবধারা ও কীর্তন-সংস্কৃতি এই দোলযাত্রার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।
দোলযাত্রা: বাংলার হাজার বছরের বৈদিক ঐতিহ্যের জীবন্ত নিদর্শন
বৈদিক ঋষিদের চিন্তা, বৈষ্ণবধর্মের আবেগ, গুপ্ত ও পাল সাম্রাজ্যের পুনর্জাগরণ, চৈতন্য মহাপ্রভুর আধ্যাত্মিক আন্দোলন এবং রবীন্দ্রনাথের বসন্তোৎসব—এইসব কিছু মিলিয়েই দোলযাত্রা বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে।
দোলযাত্রা শুধুমাত্র রঙের উৎসব নয়, এটি বাঙালির বৈদিক আত্মপরিচয়ের এক উজ্জ্বল প্রতীক। বসন্তের আনন্দ, রঙের খেলা ও বৈষ্ণবভক্তির মেলবন্ধনে দোলযাত্রা আজও বাংলার ঐতিহ্যের এক অমূল্য রত্ন হয়ে রয়েছে।
ছবির কৃতিত্ব: হাওড়া জেলা আদালতের অ্যাডভোকেট দীপিকা