২২ আগস্ট ২০২৫ এ সুপ্রিম কোর্ট জানায়—নিরীহ কুকুরকে নির্বীজ ও টিকা দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে, তবে হিংস্র ও জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুরকে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখতে হবে।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায় : অবাধে ঘুরে বেড়ানো কুকুরদের কারণে নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা, শিশু ও বৃদ্ধদের জীবনাধিকার এবং পশুকল্যাণ সম্পর্কিত সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে এ.বি.সি. বিধি ২০২৩ এবং আদালতের নির্দেশাবলীর যৌথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, যা সমগ্র ভারতবর্ষে কার্যকর হবে এবং সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এতে পক্ষভুক্ত হয়েছে।
দিল্লিতে এক ছয়-বছর-বয়সী কন্যাশিশুর কুকুরের কামড়ে রেবিজে মৃত্যুর ঘটনা টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃস্ফূর্তভাবে মামলাটি গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে ১১ আগস্ট ২০২৫ তারিখে দুই-সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ কঠোর নির্দেশ দেয় যে দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলের সমস্ত পথকুকুর ধরপাকড় করে স্থায়ীভাবে শেল্টার/পাউন্ডে রাখা হোক, তাদের নির্বীজকরণ, কৃমিনাশন ও টিকাদান করা হোক এবং কোনো অবস্থায় তাদের রাস্তার উপর ছাড়া যাবে না। এই আদেশের বিরুদ্ধে পশুপ্রেমী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি হস্তক্ষেপ আবেদন দাখিল করে যুক্তি দেখায় যে, এটি এ.বি.সি. বিধি ২০২৩-এর নিয়ম ১১(১৯)-এর লঙ্ঘন, যেখানে বলা হয়েছে নির্বীজকরণ ও টিকাদানের পর কুকুরদের পুনরায় তাদের এলাকায় ছেড়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক। তাদের আশঙ্কা, পৌর সংস্থার সীমিত ক্ষমতার কারণে লক্ষ লক্ষ কুকুরকে আবাসন দেওয়া সম্ভব হবে না এবং আদেশ কার্যকর করার নামে তাদের মেরে ফেলা হবে।
অন্যদিকে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জানান, দিল্লি ও এনসিআর অঞ্চলে আক্রমণাত্মক ও রেবিজ-আক্রান্ত কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে শিশু, বৃদ্ধ ও সাধারণ মানুষ গুরুতর বিপদের মুখে। ২০২৪ সালে প্রায় ৩৭ লক্ষাধিক কুকুরের কামড়ের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে এবং বহু মানুষ রেবিজে মারা গেছে। নির্বীজকরণ একা যথেষ্ট নয়, কারণ আক্রমণাত্মক কুকুর টিকা নেওয়ার পরও আক্রমণ করতে পারে। অতএব নাগরিকদের জীবনাধিকার (সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ) সুরক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।
তিন-সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ ২২ আগস্ট ২০২৫ তারিখে রায় প্রদান করে জানায়, মূল আদেশের অভিপ্রায় প্রশংসনীয় হলেও কার্যত ও আইনগতভাবে তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর করা সম্ভব নয়। তাই আদেশ সংশোধন ও স্পষ্টীকরণ করা হলো। আদালত নির্দেশ দেয় পৌর সংস্থাগুলি নির্বীজকরণ, কৃমিনাশন ও টিকাদানের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে। তবে এখন থেকে নির্বীজকরণ ও টিকাদানের পর কুকুরদের পুনরায় তাদের এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হবে, কিন্তু যারা রেবিজে আক্রান্ত বা আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করবে, তাদের কোনো অবস্থায় রাস্তায় ফেলা যাবে না; তাদের জন্য বিশেষ আশ্রয়কেন্দ্র নির্ধারিত হবে।
তিন বিচারপতি বিক্রম নাথ, সন্দীপ মেহতা ও এন.ভি. অঞ্জারিয়া স্পষ্টীকরণ দেয়—
- সাধারণ নির্বীজ, টিকাপ্রাপ্ত ও কৃমিনাশক দেওয়া কুকুরকে আবার তার পুরনো এলাকায় ফিরিয়ে দিতে হবে।
- জলাতঙ্ক আক্রান্ত বা হিংস্র কুকুরকে কোনো অবস্থাতেই রাস্তায় ফেলা যাবে না, তাদের আলাদা শেল্টারে রাখতে হবে।
- প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা ফিডিং জোন তৈরি হবে, রাস্তায় কুকুর খাওয়ানো নিষিদ্ধ।
- নির্দেশ অমান্য করলে জরিমানা ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- প্রতিটি এনজিওকে ২ লাখ টাকা এবং প্রতিটি ব্যক্তিকে ২৫ হাজার টাকা কোর্টে জমা দিতে হবে, যা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরিতে ব্যবহার হবে।
- পশুপ্রেমীরা চাইলে কুকুর দত্তক নিতে পারবেন, তবে রাস্তায় না ফেরানোর দায়িত্ব তাদেরই।
- ভারতের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে এই মামলায় পক্ষভুক্ত করা হলো।
আদালত আরও নির্দেশ দেয়, প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট ফিডিং জোন তৈরি করতে হবে এবং কুকুরদের কেবলমাত্র সেখানেই খাদ্য প্রদান করা যাবে। রাস্তায় বা সর্বজনীন স্থানে খাবার খাওয়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাগরিকরা যেন অভিযোগ করতে পারেন, তার জন্য পৌর সংস্থাগুলিকে বিশেষ হেল্পলাইন চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পশুপ্রেমী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, আদালতে মামলাটি চালিয়ে যেতে হলে ব্যক্তিদের ₹২৫,০০০ এবং সংগঠনগুলিকে ₹২,০০,০০০ রেজিস্ট্রিতে জমা দিতে হবে। এই অর্থ পৌর সংস্থাগুলি কুকুরদের যত্ন ও পরিকাঠামো গঠনে ব্যয় করবে। আগ্রহী পশুপ্রেমীরা কুকুর দত্তক নিতে পারবেন, তবে নিশ্চিত করতে হবে যেন তারা পুনরায় রাস্তায় ফিরে না যায়।
সর্বোচ্চ আদালত স্বীকার করে যে, সমস্যা শুধু দিল্লি-এনসিআর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; সমগ্র ভারতবর্ষে সমভাবে বিদ্যমান। তাই সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পশুপালন বিভাগ এবং স্থানীয় সংস্থাগুলিকে পক্ষভুক্ত করে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তদুপরি, উচ্চ আদালতগুলিতে ঝুলে থাকা একই ধরনের আবেদনও সুপ্রিম কোর্টে স্থানান্তরিত করা হবে।
মামলাটি আট সপ্তাহ পরে পুনরায় তালিকাভুক্ত হবে এবং সমস্ত পৌর সংস্থা ও রাজ্যগুলির কাছ থেকে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।
এভাবে সর্বোচ্চ আদালত নাগরিকদের জীবনরক্ষার অধিকার ও পশুকল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করে এক বাস্তবসম্মত, বৈজ্ঞানিক ও মানবিক সমাধান পেশ করেছে।
২২ আগস্ট ২০২৫