সঙ্ঘপ্রধান ড. মোহন ভাগবত ১০০ বছরের সংলাপে অখণ্ড ভারত, ঐক্য, সংস্কৃতি ও হিন্দুরাষ্ট্রের ভাবনা তুলে ধরলেন।
২৮শে আগস্ট ২০২৫, বৃহস্পতিবার, তিন দিনের বক্তৃতা-পর্বের শেষ দিনে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরকার্যবাহক ড. মোহন ভাগবতজি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং সঙ্ঘ-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “ভারত অখণ্ড, এটাই জীবন-সত্য। আমাদের পূর্বপুরুষ, সংস্কৃতি ও মাতৃভূমি আমাদের একত্রিত করে। অখণ্ড ভারত মানে শুধু রাজনীতি নয়, মানুষের চেতনায় ঐক্যের প্রকাশ। যখন এই অনুভূতি জেগে উঠবে, তখন শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে সঙ্ঘ কারো বিরুদ্ধে নয়। “আমাদের পূর্বপুরুষ ও সংস্কৃতি একই। পূজার পদ্ধতি আলাদা হতে পারে, কিন্তু পরিচয় এক। ধর্মান্তর করলে সমাজ পাল্টায় না। উভয় পক্ষেরই পারস্পরিক আস্থা গড়ে তুলতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে যে ভয় রয়েছে—একত্র হলে ইসলাম হারিয়ে যাবে—এই আশঙ্কা দূর হওয়া প্রয়োজন।” তিনি এটিও উল্লেখ করেন যে, মথুরা ও কাশীকে ঘিরে হিন্দু সমাজের আবেগ একেবারেই স্বাভাবিক।
সোম ও মঙ্গল দিনে দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে অনুষ্ঠিত সঙ্ঘের শতবর্ষ উপলক্ষে সংলাপ কর্মসূচিতে তিনি নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তৃতীয় দিনে প্রশ্নোত্তরের সময় তিনি স্পষ্ট করেন যে স্বাধীনতা আন্দোলন ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সঙ্ঘের ভূমিকা আছে, তবে সঙ্ঘ কখনো আলাদা পতাকা নিয়ে আন্দোলনে নামে না; স্বয়ংসেবকেরা নিজেদের বিবেকমতে সৎ কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে স্বাধীন।
কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “সঙ্ঘের কোনো অধীনস্ত সংগঠন নেই, প্রত্যেকটি স্বাধীন ও স্বশাসিত।” রাজনৈতিক দল বা অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মতভেদ হতে পারে, কিন্তু সেটি সত্যের অনুসন্ধানেরই অংশ। সংগ্রামকে তিনি অগ্রগতির মাধ্যম হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। “মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের ভেদ নেই। এই বিশ্বাসই সবাইকে এক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।”
অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতিহাসে যেমন জয়প্রকাশ নারায়ণ থেকে প্রণব মুখার্জি পর্যন্ত অনেকেই সঙ্ঘ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছেন। “যদি সৎকর্মে সাহায্য চাওয়া হয়, সঙ্ঘ সবসময় সহযোগিতা করে। যদি বিরোধ আসে, আমরা তাদের ইচ্ছাকে সম্মান করি।”
যুবসমাজ ও কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের চাকরিপ্রার্থী নয়, কর্মদাতা হতে হবে। জীবিকা মানেই চাকরি—এই ভ্রান্তি ভাঙতে হবে। সরকার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর্মসংস্থান দিতে পারে, বাকি আমাদের শ্রমেই অর্জন করতে হবে। কাজকে ‘হীন’ মনে করার কারণে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্রমের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যুবকরাই পরিবারের ভিত্তি গড়তে সক্ষম, এই শক্তি থেকেই ভারত বিশ্বের জন্য কর্মশক্তি জোগাতে পারবে।”
জনসংখ্যা প্রসঙ্গে তিনি ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। “জাতীয় স্বার্থে প্রত্যেক পরিবারের তিনটি সন্তান হওয়া উচিত, এর বেশি নয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিতও হতে হবে, আবার পর্যাপ্তও থাকতে হবে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, অনুপ্রবেশ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ফলে জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন বিপজ্জনক হতে পারে। “সংখ্যার চেয়ে উদ্দেশ্যই বড়। জোর করে ধর্মান্তর হলে তা থামাতে হবে। অবৈধ অনুপ্রবেশও উদ্বেগজনক। কর্মসংস্থান আমাদের নাগরিকদের জন্য হওয়া উচিত।”
তিনি বলেন, সঙ্ঘ শুরু থেকেই ভারতের বিভাজনের বিরোধিতা করেছে। “বিভাজনের ক্ষতিকর প্রভাব আজও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে দেখা যাচ্ছে। ভারত অখণ্ড—এটাই সত্য। অখণ্ড ভারত কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এটি মানুষের চেতনার ঐক্য।” তিনি এটিও ব্যাখ্যা করেন, “আমরা ‘হিন্দু’ বলি, আপনি ‘ভারতীয়’ বলুন—মানে একই। পূজার পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু পরিচয় এক। খ্রিস্টান বা ইসলাম গ্রহণ করলেও আমরা ইউরোপীয় বা আরব নই, আমরা ভারতীয়।”
তিনি বলেন, আক্রমণকারীদের নামে স্থান নামকরণ উচিত নয়; তবে এর মানে মুসলমানদের নামে হতে পারবে না তা নয়। বরং প্রকৃত বীরদের নামে হওয়া উচিত, যেমন আবদুল হামিদ, অশফাকউল্লাহ খান বা এপিজে আব্দুল কালাম।
হিংসার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, “যদি সঙ্ঘ হিংস্র সংগঠন হতো, তবে আমরা ৭৫ হাজার স্থানে পৌঁছতে পারতাম না। কোনো স্বয়ংসেবকের বিরুদ্ধে হিংসার অভিযোগ নেই। বরং সঙ্ঘের সেবামূলক কাজই দেখা উচিত।”
সংরক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটি তর্কের নয়, সংবেদনশীলতার বিষয়। যেখানে অন্যায় হয়েছে, তা সংশোধন করতে হবে।” সঙ্ঘ সবসময় সাংবিধানিক সংরক্ষণের পক্ষে ছিল এবং থাকবে।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভিত্তিক বৈষম্যের কোনো স্থান হিন্দুধর্মে নেই। “লোকাচারই প্রকৃত প্রথা। আর ভারতীয় সমাজ জাতিভেদ মানে না। সঙ্ঘও চায় সব সম্প্রদায়ের নেতারা একত্র হয়ে সমাজের কল্যাণে কাজ করুন।”
ভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সব ভারতীয় ভাষাই জাতীয়। তবে পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য একটি ব্যবহারভাষা প্রয়োজন, যা বিদেশি নয়।” তিনি মাতৃভাষার গুরুত্বের পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষা এবং একটি সাধারণ ভাষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন।
সঙ্ঘ পরিবর্তনশীল হলেও তিনটি বিষয়ে অটল—ব্যক্তিত্বগঠন দ্বারা সমাজপরিবর্তন, সমাজসংগঠন দ্বারা রূপান্তর, এবং ভারত হিন্দুরাষ্ট্র।
শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল তথ্য নয়, মূল্যবোধ গঠন। আধুনিকতা ও প্রযুক্তি শিক্ষার বিরোধী নয়। আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ, তা অবশ্যই পড়ানো উচিত।”
কাশী-মথুরা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হিন্দু সমাজের আবেগকে সম্মান করতে হবে। তবে রামমন্দির আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও ভবিষ্যতে সঙ্ঘ সরাসরি কোনো আন্দোলনে যুক্ত হবে না।
অবসর নিয়ে তিনি বলেন, সঙ্ঘে অবসরের ধারণা নেই। “আমরা সকলে স্বয়ংসেবক। যে কাজ দেওয়া হবে, তা করতেই হবে।”
নারীর ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নারী-পুরুষ পরিপূরক। ১৯৩৬ সালেই রাষ্ট্রীয় সেভিকা সমিতি গড়ে ওঠে, আজও তা সক্রিয়।
খাদ্যাভ্যাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “উৎসব-উপবাসে অন্যের অনুভূতিকে আঘাত না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে কে কী খাবে, তা নিয়ে বিরোধ অযথা।”
মন্দির পরিচালনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মন্দিরগুলিকে ভক্তদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে, তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য।
তিনি জানান, বর্তমানে সঙ্ঘের সক্রিয় স্বয়ংসেবক সংখ্যা প্রায় ৫–৭ লাখ এবং পূর্ণকালীন প্রচারক প্রায় ৩৫০০ জন।
বিদেশি অর্থায়নে ধর্মান্তর প্রসঙ্গে তিনি কঠোর নজরদারির আহ্বান জানান। “বিদেশি অর্থ যদি সেবায় ব্যবহৃত হয়, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু তা ধর্মান্তরে ব্যয় হলে তা বিপজ্জনক।”
শেষে তিনি পুনরায় বলেন, ভারত হিন্দুরাষ্ট্র, এবং এর জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন নেই। “আমাদের ঋষি-মুনি বহু পূর্বেই ঘোষণা করেছেন যে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র। এটি অনুমোদননির্ভর নয়, এটি সত্য। গ্রহণ করলে মঙ্গল, অগ্রাহ করলে অমঙ্গল।”
August 29, 2025