বর্গাদারদের অধিকার, ভূমি চাষের নিয়ম এবং ভূমি সংস্কারের মূল দিক

Date: 5th March 2025

(পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন, ১৯৫৫)

ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন, ১৯৫৫ (West Bengal Land Reforms Act, 1955) হল রাজ্যের ভূমি মালিকানা, কৃষিজমির ব্যবহার এবং বর্গাদারদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রণীত একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এটি মূলত ভূমির ন্যায্য বণ্টন, কৃষকদের সুরক্ষা এবং জমির অধিকারের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে প্রণীত হয়।

“বর্গাদার” (Bargadar) কারা?

আইনের সংজ্ঞা( Sec 2) অনুযায়ী, “বর্গাদার” বলতে সেই কৃষককে বোঝানো হয় যিনি অন্য ব্যক্তির জমি চাষ করেন এবং উৎপাদিত ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ জমির মালিককে প্রদান করেন

✔ বর্গাদার অন্তর্ভুক্ত:

আদি, বর্গা বা ভাগ প্রথার অধীনে জমি চাষকারী।
“কিসানি” বা অন্য কোনো নামে পরিচিত কৃষক, যিনি জমির মালিকের কাছ থেকে ফসলের ভাগ পান।

✔ বর্গাদার অন্তর্ভুক্ত নয়:

নিম্নলিখিত নিকট আত্মীয়রা বর্গাদার হিসেবে বিবেচিত হবেন না:

  • স্ত্রী বা স্বামী
  • পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনি
  • পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, ঠাকুরদা-ঠাকুরমা
  • ভাই, বোন
  • ভাই বা বোনের সন্তান
  • জামাই বা পুত্রবধূ
  • শ্বশুর বা শাশুড়ি

উল্লেখ্য, বর্গাদার তার অধিকার আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকবে যতক্ষণ না তার চাষের অধিকার আইনত বাতিল করা হয়।

বর্গাদারদের অধিকার ও সুরক্ষা

১. জমি চাষের অধিকার সংরক্ষণ (ধারা ১৫)

ভূমি সংস্কার আইনের অধীনে, যতদিন বর্গাদার জমি চাষ চালিয়ে যাবেন, ততদিন মালিক তাকে উচ্ছেদ করতে পারবেন না
এই অধিকার উত্তরাধিকারযোগ্য, তবে হস্তান্তরযোগ্য নয়। অর্থাৎ, বর্গাদারের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা চাষ চালিয়ে যেতে পারেন।

২. বর্গাদারের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের অধিকার (ধারা ১৫এ)

বর্গাদারের মৃত্যুর পর, তার বৈধ উত্তরাধিকারীরা জমি চাষ করতে পারবেন
যদি উত্তরাধিকারীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাষের অধিকার স্থির করতে ব্যর্থ হন, তবে সরকার মনোনীত কর্মকর্তা যে উত্তরাধিকারী জমি চাষ করতে সক্ষম, তাকে মনোনীত করবেন

৩. উৎপাদিত ফসলের ভাগ বণ্টন (ধারা ১৬)

বর্গাদারের উৎপাদিত ফসলের ভাগ নির্ধারণ করা হয়েছে:

✔ ৫০:৫০ ভাগে ভাগ হবে, যদি জমির মালিক হাল, গবাদি পশু, সার ও বীজ প্রদান করেন
✔ ৭৫:২৫ ভাগ হবে, যদি বর্গাদার নিজ খরচে সমস্ত কৃষি উপকরণ জোগান দেন।

বর্গাদার ফসলের নির্ধারিত ভাগ নির্দিষ্ট সময়ে জমির মালিককে দিতে বাধ্য। যদি জমির মালিক তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, তবে সরকার-নির্ধারিত কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে।

বর্গাদারদের উচ্ছেদ ও চাষের অধিকার বাতিলের শর্ত (ধারা ১৭)

🔸 কেবলমাত্র সরকার-নিযুক্ত কর্মকর্তা বা আদালতের আদেশে বর্গাদারদের উচ্ছেদ করা যাবে।
🔸 নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে বর্গাদারদের উচ্ছেদ করা যেতে পারে:

যদি তিনি অযৌক্তিক কারণে চাষ না করেন বা কৃষি ছাড়া অন্য কাজে জমি ব্যবহার করেন
যদি তিনি নিজে চাষ না করেন এবং অন্য কাউকে দিয়ে করান
যদি তিনি উৎপাদিত ফসলের মালিকের ভাগ না দেন
যদি ভূমি মালিক তার জমিটি ব্যক্তিগত চাষের জন্য প্রয়োজন বলে প্রমাণ করতে পারেন (তবে ৩ হেক্টরের বেশি জমি মালিক নিজে রাখতে পারবেন না)।

তবে যদি জমির মালিক দুই বছরের মধ্যে ব্যক্তিগত চাষ শুরু না করেন, তাহলে জমিটি সরকারের অধীনে নিয়ে নেওয়া হবে।

অতিরিক্ত জমি চাষের নিষেধাজ্ঞা (ধারা ১৭(৪))

কোনো বর্গাদার ৪.০০ হেক্টরের বেশি জমি চাষ করতে পারবেন না
যদি তিনি নির্ধারিত সীমার বেশি জমি চাষ করেন, তবে অতিরিক্ত জমির উৎপাদিত ফসল সরকারের মালিকানায় যাবে

এই আইনের প্রভাব ও গুরুত্ব

পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন, ১৯৫৫ মূলত ভূমির সুষম বণ্টন, বর্গাদারদের অধিকার সুরক্ষা ও কৃষকদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে

✔ কৃষকদের অধিকারের সুরক্ষা: এই আইন জোতদারদের অন্যায় শোষণ রোধ করেছে
✔ ভূমির সুষম বণ্টন: ভূমিহীন কৃষকদের কৃষিজমির মালিকানা পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
✔ বৈধ উত্তরাধিকার সংরক্ষণ: বর্গাদারের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের চাষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
✔ ভূমির ন্যায্য ব্যবহার: অযৌক্তিক উচ্ছেদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং জমির মালিকদের জমি ব্যক্তিগত চাষের জন্য ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *