প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবসভ্যতার এক বিভীষিকাময় অধ্যায়।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগস্টের দিনটি ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে কলঙ্কময়তম এক অধ্যায়—যা ‘Direct Action Day’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন’ নামে কুখ্যাত। মুসলিম লীগ এই দিনকে ঘোষিত করেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়কে দমন করে পাকিস্তানের দাবিকে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া। কলকাতাকেই এই ভয়াবহ দাঙ্গার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল, কারণ বাংলার প্রশাসন তখন মুসলিম লীগের কব্জায় এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সুরাবর্দী সরাসরি কলকাতার মুসলিম গুন্ডাদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এই ঘটনার আগের কয়েক সপ্তাহ ধরেই মুসলিম লীগের সংবাদপত্র ও প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষ পরিকল্পনা সাজানো হয়। ঘোষণা করা হয়েছিল—১৬ই আগস্টে হরতাল হবে, মিছিল ও শোভাযাত্রা বের হবে, প্রত্যেক মসজিদে বিশেষ মুনাজাত হবে এবং পাকিস্তানের জন্য ‘জেহাদ’-এর ডাক দেওয়া হবে। ১৫ই আগস্ট রাত থেকেই কলকাতার বহু মসজিদে অস্ত্র মজুত হয়, ট্রাকভর্তি সশস্ত্র যুবক প্রস্তুত থাকে, পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে স্লোগান ওঠে—“পাকিস্তান জিন্দাবাদ।”
ভোর হতে না হতেই দাঙ্গার আগুন জ্বলে ওঠে। রাজাবাজার, বড়বাজার, কলেজ স্ট্রীট, চিৎপুর, এন্টালি, বেলেঘাটা, খিদিরপুর—প্রতিটি অঞ্চলে দলে দলে মুসলিম দাঙ্গাবাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র হিন্দু জনপদে। খুন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ, নারী অপহরণ—কোনও কিছুই বাদ যায়নি। বড়বাজারে বিশেষত মারোয়ারী ব্যবসায়ীরা টার্গেট হয়, অন্যত্র অসংখ্য বাঙালি হিন্দু নিহত হন। রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহের স্তূপ জমে ওঠে, পচনধরা লাশ থেকে আসা দুর্গন্ধ লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অথচ সুরাবর্দীর সরাসরি নির্দেশে পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে থাকে।
এই সময় সুরাবর্দী প্রকাশ্যে বলেছিলেন—“২৪ ঘণ্টা সময় দিলাম, যা করার কর।” বাস্তবে এর অর্থ ছিল হিন্দু নিধনের জন্য পুরো এক দিনের লাইসেন্স। তিনি নিজে লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে দাঙ্গার খবরাখবর নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। সভা-মিছিলে তাঁর ও নাজিমুদ্দীনের উত্তেজনামূলক বক্তৃতা পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তোলে। আবুল হাসিম ঘোষণা করেন—“মুসলমানরা সাংবিধানিক পথ ত্যাগ করেছে, এখন থেকে সরাসরি সংগ্রাম চলবে।” রমজান মাসকে ‘জেহাদের মাস’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, কারণ ঐ মাসেই কোরান নাযিল হয়েছিল, মক্কা বিজয় হয়েছিল, আর এখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইও সে মাসেই শুরু করা হবে।
এই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা কেবল কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর বহ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়েছিল নোয়াখালি, বিহার, পাঞ্জাব পর্যন্ত। লক্ষ লক্ষ হিন্দু খুন হন, অসংখ্য নারী ধর্ষিতা ও অপহৃত হন, কোটি কোটি মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। কলকাতার দাঙ্গাই ছিল ভারতের বিভাজনের পূর্বাভাস এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পথে রক্তাক্ত প্রথম পর্ব।
আজও বলা হয়—“ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল August 25, 2025 বিনা রক্তপাতে।” অথচ সেই কথার আড়ালে চাপা পড়ে আছে ১৯৪৬-এর সেই ভয়াবহ গণহত্যার ইতিহাস, যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল হিন্দু রক্তের স্রোতে। এই দিনের নৃশংসতা, সুরাবর্দীর ভূমিকা, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদত—সবই ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট ও মুসলিম লীগের আঁতাতে সত্য ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে।
১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার প্রত্যক্ষ সাক্ষীরা একে নরকযন্ত্রণা বলে বর্ণনা করেছেন। জি. ডি. বিড়লা ১৬ আগস্টের পর মহাত্মা গান্ধীকে লিখেছিলেন, শহর রক্তে ভেসে গেছে—প্রায় সাত হাজার মানুষ নিহত, পনেরো হাজার গুরুতর আহত এবং এক লক্ষেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। তাঁর ভাষায়, কয়েক দিনের মধ্যে কলকাতা নাদির শাহের দিল্লী আক্রমণের পুনরাবৃত্তি প্রত্যক্ষ করল। নেহরু ১৭ আগস্ট জি. ডি. বিড়লাকে পত্রে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখেন, তিনি ভীষণ ক্লান্ত; এ মুহূর্তে তাঁর কোনো মুসলমান বন্ধু নেই, কারণ মুসলিম নেতৃত্ব সম্পূর্ণ অকর্মণ্য প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর কথায়, রক্তাক্ত হাতে করমর্দন করা সম্ভব নয়।
দাঙ্গার দ্বিতীয় দিনে এ. কে. ফজলুল হক শহরে বেরিয়ে রাস্তাজুড়ে মৃতদেহ, আগুনে পোড়া ঘরবাড়ি, ধ্বংসস্তূপ দেখে মর্মাহত হন। তিনি মন্তব্য করেন, যেন ১৭৪০ সালে নাদির শাহ দিল্লী আক্রমণের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তরুণ কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু লিখেছিলেন, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো তাঁর কাছে বিভীষিকা ছিল—শ্বাসরুদ্ধকর দুর্গন্ধ, রক্তাক্ত লাশ, পোড়া বাড়িঘর দেখে তিনি বিস্মিত হন, মানুষ এতটা নৃশংস হতে পারে ভেবেও পাননি।
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীর বোন লেডি হাসান শেফা লিখেছেন, তাদের বাড়ির কাছেই পচা লাশ পড়ে থাকত—ধড় থেকে মাথা আলাদা, হাত-পা বিচ্ছিন্ন দৃশ্য চোখে দেখেছেন তিনি। আই.সি.এস. অফিসার পি. এস. মাথুর লিখেছেন, তিনি গাড়ি চালানোর সময় রাস্তায় শোয়া মৃতদেহ চাকার নিচে চাপা পড়ছিল, যা তাঁর কল্পনারও বাইরে ছিল। গান্ধীজি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, অহিংসা যদি ব্যর্থ হয় তবে ভারতবর্ষ রক্তস্নানে ডুবে যাবে, আর কলকাতার রাস্তায় তিনি সেই রক্তস্নানের আভাস দেখেছেন।
এই সব দলিল প্রমাণ করে, কলকাতার দাঙ্গা ছিল পূর্বপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক ভয়াবহতম অধ্যায়।
August 25, 2025
Read More
কলকাতায় স্থগিত ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ট্রেলার: বিতর্কের ঝড়