১২ এপ্রিল ২০২৫
ওয়াক্ফ (সংশোধন) আইন ২০২৫: বিতর্ক ও প্রতিবাদ
ভারতের ওয়াক্ফ আইন ১৯১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে ২০২৫ সালের সংশোধনী পর্যন্ত এসেছে সমাজকল্যাণ ও ধর্মীয় সম্পত্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে। এর মূল লক্ষ্য ছিল ওয়াক্ফ (Waqf) সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। তবে, এই আইনের সর্বশেষ সংশোধনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ভয়াবহ হিংসার ঘটনা ঘটেছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রণীত ওয়াক্ফ (সংশোধন) আইন ২০২৫–এর প্রতিবাদে ইসলামপন্থীদের দ্বারা মুর্শিদাবাদের সুতী ও সামসেরগঞ্জে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরে রক্তক্ষয়ী হিংসায় রূপ নেয়। শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকাল পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে এক পিতা-পুত্র রয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে, এবং ১৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “এই আইন আমাদের রাজ্য সরকার প্রণয়ন করেনি। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের আইন। আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, এই আইন বাংলায় কার্যকর হবে না।”
অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে রাজ্যপক্ষের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর করা রিট (Writ) পিটিশনের ভিত্তিতে বিচারপতি সৌমেন সেন-এর নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী (CRPF) মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। আদালত জানিয়েছে, “এমন পরিস্থিতিতে আদালত চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারে না। সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে হবে।”
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব গোবিন্দ মোহন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব এবং ডিজিপির সাথে একটি ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছেন। ডিজিপি সচিবকে অবহিত করেছেন যে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
মিঃ মোহন বলেন যে মুর্শিদাবাদে স্থানীয়ভাবে প্রায় ৩০০ বিএসএফ সদস্য ছাড়াও, রাজ্য সরকারের অনুরোধে অতিরিক্ত ৫ কোম্পানি মোতায়েন করা হয়েছে।
হিংসার বিবরণ
- জাফরাবাদে একটি পরিবারে পিতা-পুত্রকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
- সুতীর সাজুর মোড়ে ২১ বছর বয়সী যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
- সামসেরগঞ্জের ধুলিয়ানে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে দুই বিড়ি কারখানা শ্রমিক, একজন নাবালক সহ, গুলিবিদ্ধ হন।
- বিক্ষোভকারীরা পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়, রেললাইন ও রাস্তা অবরোধ করে।
- নিউ ফরাক্কা-আজিমগঞ্জ রেলপথের ধুলিয়ানডাঙ্গা থেকে নিমতিতা পর্যন্ত প্রায় ছয় ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।
অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইন ও শৃঙ্খলা) জাওয়েদ শামিম জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজ্যজুড়ে ১৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওয়াক্ফ আইন সংস্কারের ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিকতা
- ১৯১৩ সালের মুসলমান ওয়াক্ফ আইনের মধ্য দিয়ে ভারতে ওয়াক্ফ ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
- ১৯৯৫ সালের কেন্দ্রীয় আইন ও ২০১৩ সালের সংশোধনীতে প্রশাসনিক কাঠামো সুসংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
- ২০২৪ সালে মুসলমান ওয়াক্ফ (রিপিল) বিল প্রস্তাবিত হয় পুরাতন ব্যবস্থাগুলিকে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে।
- ২০২৫ সালের সংশোধনীতে আরও স্বচ্ছতা, হিসাবদারিত্ব ও ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবস্থার জোর দেওয়া হয়েছে।
WAMSI পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ৮.৭২ লক্ষ ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ১০৮৩টির দানপত্র (deed) আপলোড করা হয়েছে।
রাজনৈতিক উত্তেজনা ও প্রতিক্রিয়া
বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার রাজ্য সরকারকে “হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ” বলে অভিযুক্ত করেছেন। পাশাপাশি, রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে লেখা চিঠিতে অধিকারী রেল সম্পত্তি ভাঙচুরের তদন্ত এনআইএ-এর মাধ্যমে করার দাবি জানিয়েছেন।
এক্স-এ দেওয়া পোস্টে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, “ধর্মের নামে কোনো অনৈতিক আচরণ করবেন না। মানবজীবন অমূল্য, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য দাঙ্গা না করুন। শান্ত থাকুন, সংযম রাখুন।”
গতকাল নতুন আইনের প্রতিবাদে মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হুগলি জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে পুলিশ ভ্যান সহ বেশ কয়েকটি যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পাথর ছোঁড়া হয় এবং রাস্তা অবরোধ করা হয়।
পুলিশ মহাপরিচালক রাজীব কুমার আন্দোলনকারীদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে বিক্ষোভের নামে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার কোনও প্রচেষ্টা রাজ্য পুলিশ সহ্য করবে না।