বিচারপ্রার্থীর আস্থা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আলোড়ন
হাওড়া জেলার নিম্ন আদালতগুলিতে সম্প্রতি এক বিতর্কিত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আইনজীবী ও মামলার পক্ষগণ আপত্তি জানালেও, একাধিক মুলতুবি মামলা হঠাৎই মধ্যস্থতায় পাঠানো হচ্ছে। গতকাল ১৯ আগস্ট ২০২৫ তারিখে এরকম একটি ঘটনার সাক্ষী হলো সপ্তম বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। একটি গার্হস্থ্য হিংসার মামলায় চারবার তারিখ বাড়ানোর (মুলতুবির) পর এবং স্ত্রীর পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন ভরণপোষণ আবেদন শুনে, হঠাৎ করেই মামলাটি মধ্যস্থতায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। স্ত্রী-পক্ষের আইনজীবী তীব্র আপত্তি জানালেও আদালত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি।
গার্হস্থ্য হিংসা আইন অনুযায়ী, এই ধরনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা আবশ্যক। কারণ আইনটি মহিলাদের সুরক্ষার জন্য প্রণীত। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক বিচারকই এই মামলার প্রকৃতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন না। আইন অনুসারে এটি মূলত দেওয়ানি প্রকৃতির, তবে ফৌজদারি আদালতের হাতে বিচারভার অর্পিত হয়েছে। কার্যত এটি একটি সমন মামলা, যেখানে বিচারক চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন ভরণপোষণ বা সুরক্ষার আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কাস্টমাইজড পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। এমনকি শপথপত্রের ভিত্তিতে একতরফা অন্তর্বর্তীকালীন ভরণপোষণ মঞ্জুর করাও সম্ভব। এইসব ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো দ্রুত বিচার ও দুর্বল মহিলাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
শোনা যাচ্ছে, কলকাতা হাইকোর্ট মৌখিকভাবে নিম্ন আদালতগুলোকে যতটা সম্ভব মামলা মধ্যস্থতায় পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছে। তবে লিখিত কোনো নির্দেশ কখনো জারি হয়নি। অথচ মধ্যস্থতা প্রসঙ্গে সাধারণ মানুষের ধারণা একেবারেই নেতিবাচক—বিশেষত হাওড়া জেলায়। দাবি-সংক্রান্ত মামলায় মধ্যস্থতা প্রায়শই একপেশে হয়। বিদ্যুৎ বা টেলিফোন বিল নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী প্রায়শই সংস্থার পক্ষ নেন। আবার বৈবাহিক মামলায় আইন বলছে মধ্যস্থতার ফল আদালতের ডিক্রির সমান গণ্য হবে, কিন্তু হাওড়ার আদালত নিজেরাই সেই ফল গ্রহণ করেন না।
একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখযোগ্য। হাওড়ার দ্বিতীয় ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্ট একটি বৈবাহিক মামলা মধ্যস্থতায় পাঠায়। অভিজ্ঞ মধ্যস্থতাকারী শান্তনা বাগ মামলাটি সুচারুভাবে পরিচালনা করে পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদর যুক্তিসম্পন্ন বিনির্ণয় দেন। মধ্যস্থতা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট সেটি অনুমোদন করে মূল আদালতে পাঠান। কিন্তু দ্বিতীয় ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্ট সেই বিনির্ণয় গ্রহণ না করে আবার নিয়মিত প্রমাণবহনের আদেশ দেন। এতে উভয় পক্ষ এবং আইনজীবীরা চরম হতাশ হন এবং বিচারপ্রার্থী দম্পতি আর কোনো প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
আরেকটি ক্ষেত্রে, দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা বিচারকের আদালতে চলা এক বৈবাহিক মামলায় পক্ষগণ স্পষ্টভাবে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে তারা মধ্যস্থতায় যেতে চান না। কিন্তু আদালত জোর করেই মামলাটি মধ্যস্থতায় পাঠান। অথচ ভারতীয় আইনে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার কোনো বিধান নেই। এটা কেবলমাত্র মৌখিক ইঙ্গিতের ভিত্তিতে ঘটছে।
আইনজীবী সমাজের মতে, কিছু বিচারক জটিল ও বিরোধপূর্ণ মামলা সামলাতে অনিচ্ছুক হওয়ায় মধ্যস্থতার পথ বেছে নিচ্ছেন। এতে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ ভারতীয় সমাজে আস্থা সবসময় বিচারক ও আদালতের প্রতি থেকেছে, মধ্যস্থতাকারীর প্রতি নয়। সালিশি প্রক্রিয়া যে দেশে ব্যর্থ হয়েছে, এটিই তার প্রমাণ। কলকাতায় সালিশিকে অনেকে ঠাট্টা করে “সমোসা প্রোসিডিং” বলে ডাকেন—যেখানে সালিশকারীর বাড়িতে গিয়ে সমোসা-চা খাওয়া হয় আর শুধু পরের তারিখ ঠিক হয়। সালিশি ধনী মহলের জন্য, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়।
মানুষ মনে করে, মধ্যস্থতার জন্য আদালতের চেয়ে পঞ্চায়েত অনেক বেশি কার্যকর স্থান। নতুন কোনো মামলা আরম্ভ হলে সেখানে মধ্যস্থতার সুযোগ কিছুটা থাকতে পারে, কিন্তু যেসব মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে, সেগুলোকে আবার মধ্যস্থতায় পাঠানো একেবারেই অনুচিত। একজন বিচারকের মনে রাখা উচিত—ন্যায়বিচারের সঙ্গে সময়মতো নিষ্পত্তি করাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিচারপ্রার্থীর আস্থা যাতে নষ্ট না হয়, সেটাই প্রধান দায়িত্ব। আর যদি অতি মাত্রায় মধ্যস্থতার আশ্রয় নেওয়া হয়, তবে সাধারণ মানুষের কাছে এটাই বার্তা যাবে যে আদালত নিজেই অক্ষম, বিচারব্যবস্থা কার্যত ব্যর্থ।
August 20, 2025