ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ: স্বদেশী ডাক ও মার্কিন পণ্যের বয়কট

ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ: স্বদেশী ডাক ও মার্কিন পণ্যের বয়কট

ট্রাম্পের ৫০% শুল্কে ভারত ক্ষুব্ধ। স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের ডাক, আত্মনির্ভর ভারতের পথে এগোচ্ছে দেশ

আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সংঘাত নতুন মোড় নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে ২৭ আগস্ট ২০২৫ থেকে ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করা হবে। এই পদক্ষেপ ভারতে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। ভারতীয় জনমানস ও বিভিন্ন সংগঠনের মত অনুযায়ী, আমেরিকা আর মিত্র নয় বরং শত্রু রাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে। দিল্লির উমেশের মতো নাগরিকরা জানিয়েছেন যে গণেশ চতুর্থী থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হবে এবং মার্কিন পণ্য ও কোম্পানির বয়কট করা হবে। কলকাতা হাইকোর্টের কিছু আইনজীবীও এই বয়কট আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন এবং এটিকে “অঙ্গীকারের সাথে পালনযোগ্য জাতীয় কর্তব্য” বলে অভিহিত করেছেন।

এই বিতর্ক শুধু আবেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ভারতের অর্থনৈতিক কৌশল, আত্মনির্ভরতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাথেও গভীরভাবে যুক্ত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মার্কিন শুল্ককে “ট্যারিফ টেররিজম” এবং “অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ” বলেছেন। তাঁর দাবি, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভারত মাথা নত করবে না। মোদী ভারতীয়দের আহ্বান জানিয়েছেন যে তারা যেন কোকা-কোলা, পেপসি, আমাজন, ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি এবং অ্যাপল-এর মতো মার্কিন ব্র্যান্ড ব্যবহার বন্ধ করে এবং “স্বদেশী” ও “ভোকাল ফর লোকাল”-এর মন্ত্রকে গ্রহণ করে। তাঁর মতে, এই সংকটকে সুযোগে পরিণত করতে হবে এবং ভারতকে বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্র হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

ভারত ও আমেরিকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। ২০২৪–২৫ সালে দুই দেশের মধ্যে মোট বাণিজ্য ২১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হয়েছে। এর মধ্যে পণ্য ও পরিষেবা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। ২০২৫ সালে ভারত আমেরিকা থেকে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের খনিজ তেল ও গ্যাস, ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের রত্ন ও ধাতু, ২.৯ বিলিয়ন ডলারের যন্ত্রপাতি, ২.৭ বিলিয়ন ডলারের বিমান ও মহাকাশ সরঞ্জাম, ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ইলেকট্রনিক পণ্য, ১.৯ বিলিয়ন ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম, ১.৬ বিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিক এবং ১.১ বিলিয়ন ডলারের ফল ও বাদাম আমদানি করেছে। এর পাশাপাশি আমেরিকা ভারতকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী, গাড়ির যন্ত্রাংশ, ওষুধ, বিশেষ রাসায়নিক, তুলা এবং নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তিও সরবরাহ করে।

ভারতের সামনে এই মুহূর্তে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ রয়েছে—একদিকে আমেরিকা তার জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও আধুনিক প্রযুক্তির বড় উৎস, অপরদিকে ভারত তার দেশীয় শিল্পকে আত্মনির্ভর করতে চায়। যদি ভারত মার্কিন পণ্যের বয়কট করে, তবে এর প্রভাব আমেরিকার অর্থনীতিতেও মারাত্মক হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় ভোক্তারা যদি মার্কিন ব্র্যান্ড ও পণ্যের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়, তবে মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক শক্তি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চীনের উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক। যখন ট্রাম্প প্রশাসন চীনের উপর কঠোর শুল্ক আরোপ করেছিল, তখন চীন তাৎক্ষণিকভাবে ‘টিট-ফর-ট্যাট’ কৌশল গ্রহণ করে—অর্থাৎ যত মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক, তত মূল্যের চীনা প্রতিশোধমূলক শুল্ক। চীন মার্কিন কৃষিজ পণ্য, গাড়ি ও রাসায়নিককে টার্গেট করে, যাতে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চাপ সৃষ্টি হয়। একইসাথে চীন আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ এবং দেশীয় বাজারকে শক্তিশালী করে ভারত তার নির্ভরশীলতা কমায়। ভারত যদি এই সংকট কাটিয়ে উঠতে চায়, তবে তাকে একইরকম বহুস্তরীয় কৌশল গ্রহণ করতে হবে—একদিকে সরাসরি প্রতিশোধ, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি আত্মনির্ভরতা।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকও বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতে অনেকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে মোদী নিজে ট্রাম্পকে মার্কিন নির্বাচনে সমর্থন করেছিলেন, অথচ আজ সেই ট্রাম্পই ভারতীয় শিল্প ও জনগণকে উপেক্ষা করছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক ধরনের “ব্যক্তিগত প্রতিশোধের রাজনীতি”, যার খেসারত দুই দেশের সম্পর্ক দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক স্তরে এই সংঘাত নতুন বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনাও তৈরি করছে। ভারত, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতার আলোচনা শুরু হয়েছে। যদি ভারত এই দেশগুলির সাথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়, তবে বৈশ্বিক বাণিজ্য ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এর জন্য ভারতকে অত্যন্ত সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ মার্কিন প্রযুক্তি ও পুঁজি এখনো তার প্রয়োজন।

তবুও, একথা স্পষ্ট যে ভারত আর বিদেশি চাপে মাথা নত করবে না। স্বদেশী চেতনা ও আত্মনির্ভর ভারতের অঙ্গীকার এই বিতর্কের কেন্দ্রে। ভারত যদি সঠিক কৌশল গ্রহণ করে, তবে এই সংকটকে সুযোগে পরিণত করতে পারবে এবং বিশ্বকে বার্তা দেবে যে এক উদীয়মান শক্তিকে অর্থনৈতিক হুমকির মাধ্যমে থামানো সম্ভব নয়।

দেহাতি: ২৭ আগস্ট, ২০২৫